• রবিবার, ০২ এপ্রিল ২০২৩, ০৬:০৮ পূর্বাহ্ন
  • Bengali Bengali English English
Logo
                               

দিনমজুর ছেলেটির মেডিকেলে সুযোগ পাওয়ার গল্প

এম এ আলিম খান / ৮৭ বার ভিজিট
আপডেটঃ বুধবার, ১৫ মার্চ, ২০২৩

১৮ বছর ধরে শিক্ষা নিয়ে কাজ করছি।  শিক্ষার মান উন্নয়ন কীভাবে করা যায়, সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানো যায় এবং শুধুমাত্র অর্থের অভাবে যেন তাঁদের স্বপ্নগুলো ভেঙ্গে না যায়; এজন্য আমার ক্ষুদ্রগন্ডির মধ্যে থেকে যতটুকু পারি আপ্রাণ করার চেষ্টা করি। আজকের শিশুরাই আগামীতে দেশের নেতৃত্ব দিবে। ওরাই আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ। সুবিধাবঞ্চিত মেধাবী শিক্ষার্থীরা একটু সহযোগিতা পেলে তাঁদের জীবনের গল্প লেখা হয় আবার নতুন করে। দূর্গম পথ পাড়ি দিয়ে তাঁদের যেতে হয় বহুদূর। আমরা হয়তো ওদের পথ দেখিয়ে দিতে পারি এবং পথে চলার জন্য কিছু খাদ্য সামগ্রী দিতে পারি এর চেয়ে বেশি আর কী করতে পারি!  অভাবের তাড়নায় একদিনের দিনমজুর ছেলেটি দূর্গম পথ পাড়ি দিয়ে কীভাবে এমবিবিএস ভর্তির সুযোগ পেল আজ সেই অজানা গল্প বলবো। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় কাজের সুবাদে আমাকে প্রায়ই যেতে হয়। বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ভলান্টিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ফর বাংলাদেশ (ভাব-বাংলাদেশ) কাজ করি । সংস্থাটির নামের সাথে কাজের অনেক মিল রয়েছে; এজন্য ২০০৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র থাকা অবস্থায় একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে শুরু করেছিলাম ভাব-বাংলাদেশ এর সাথে পথচলা। ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা এবং কখন যে সংস্থাটির কিছু ভালো মানুষের ভালোবাসা পেয়ে নিজেকে একাকার করে ফেলেছি বুঝতে পারিনি। ২০২০ সালে তাঁদের মধ্যে একজন আমাদের সবার শ্রদ্ধেয় জাতীয় অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী চলে গেলেন না ফেরার দেশে। ২০২১ সালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভিসি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর (এমিরিটাস) ড. সৈয়দ গিয়াসউদ্দিন আহমেদও চলে গেলেন না ফেরার দেশে। এখনও প্রিন্সপাল হামিদা আলী, ড. মোহাম্মদ হারুনুর রশীদ ও ড. সুলতান হাফিজ রহমানসহ কয়েকজন সাদা মনের মানুষ আছেন। তাঁদের আন্তরিকতা ও ভালোবাসা আমার কাজের শক্তি যোগায়। এতো বড় মাপের ও মনের মানুষদের সান্নিধ্যে ও ভালোবাসা পেয়ে কাজ করা কম সৌভাগ্যের কথা নয়। এদিক দিয়ে আমি অনেক ভাগ্যবান। ২০১৮ সালের প্রথমদিকে এক দিন অফিসের কাজে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার রমজাননগর ইউনিয়ন তোফাজ্জেল বিদ্যাপীঠে গিয়েছিলাম। আলোচনার এক পর্যায়ে প্রধান শিক্ষক শেখ মতিউর রহমান আমাকে বললেন, “ ভাই আমাদের একজন সুবিধাবঞ্চিত অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র আছে। আমরা স্কুলে শিক্ষকরা মিলে ওকে একটি প্যান্ট ও শার্ট কিনে দিয়েছি। স্কুলে আসার মত কোন ভালো প্যান্ট ও শার্ট‍ তার ছিল না। মাঝে মাঝে দিনমজুরি করে ও পড়ালেখা করে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষায় সে জিপিএ-৫ পেয়েছে।”ছেলেটির নাম সৌরভ চন্দ্র মন্ডল। সে নূরনগর ইউনিয়নের হরিণাগাড়ী গ্রামের দিনমজুর আনন্দ চন্দ্র মন্ডল ও অনিতা রানী মন্ডলের ছোট ছেলে। প্রধান শিক্ষকের কাছে বিস্তারিত জেনে প্রধান শিক্ষককে নিয়ে গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠো পথ পাড়ি দিয়ে সৌরভের বাড়িতে গেলাম। স্কুল থেকে ৫/৬ কিলোমিটার দূরে বাড়ি। সৌরভ ও তাঁর মা বাড়িতে ছিল। সৌরভের একমাত্র দাদা পাশে অন্যের জমিতে কাজ করছিল স্কুলের প্রধান শিক্ষক যাওয়ার খবরে তিনিও এলেন। পড়ালেখা ও পারিবারিক বিষয়ে অনেক কথা হলো তাঁদের সাথে। সৌরভের স্বপ্ন ভবিষ্যতে ডাক্তার হয়ে সে মানুষের সেবা করতে চায়। তিন বেলা ঠিকমতো খাবার জোটেনি; স্কুল বন্ধ করে তাকে অন্যের জমিতে দিনমজুরের কাজ করতে হয়েছে। ১০/১২ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে স্কুলে যাতায়াত করে ২০১৭ সালে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেলে তাঁর কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়। ভবিষ্যতে ভালো কিছু হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। হাইস্কুলে ৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে সৌরভ প্রতিদিন ১০/১২ কিলোমিটার হেঁটে স্কুলে যাতায়াত করতো। ৯ম শ্রেণিতে উঠার কিছু দিন পর দেড় হাজার টাকা দিয়ে একটি পুরানো সাইকেল কিনে সেটা চালিয়ে সৌরভ স্কুলে যায়। কষ্টের কথা বলতে বলতে সৌরভের মা একপর্যায়ে কাঁদতে লাগলেন। কীভাবে ছেলেকে লেখাপড়া শেখাবেন। কত কষ্ট করে সংসার চলে এসব কথা বলছিলেন। কষ্টের কথা শুনতে শুনতে নিজের অজান্তে কখন চোখে জল চলে এসেছে লক্ষ্য করিনি। তাঁদেরকে আশ্বস্ত করে সৌরভের পড়ালেখার সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে চলে এলাম। সৌরভের বিষয়টি অস্ট্রেলিয়ার রোটারী ক্লাব অব হুইলার্স হিলের তৎকালীন চেয়ার ভাষাতত্ত্ববিদ আমিন রহমানকে জানালাম। তিনি লায়লা চৌধুরী নামে এক নারীর স্পন্সরে প্রতিমাসে এক হাজার টাকা করে বৃত্তির ব্যবস্থা করলেন। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ভাব বাংলাদেশের মাধ্যমে নিয়মিত এই বৃত্তি প্রদানের ফলে সৌরভের লেখাপড়ার দূর্গম পথ কিছুটা সুগম হয়। ২০২০ সালে সেকেন্ডারী স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষায় সে জিপিএ-৫ (গোল্ডেন এপ্লাস) পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। লায়লা চৌধুরী দুই বছর কলেজে সৌরভকে প্রতি মাসে দুই হাজার বৃত্তি দিয়েছেন। ২০২০ সালে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় ও দৈনিক প্রথম আলোর আয়োজনে অনুষ্ঠিত ১৮তম গণিত অলিম্পিয়াড পরীক্ষায় শ্যামনগর উপজেলা থেকে সেকেন্ডারী ক্যাটাগরিতে একমাত্র সৌরভ জাতীয় পর্যায়ে অংশগ্রহনের সুযোগ পেয়েছিল। শ্যামনগর উপজেলায় এর আগে কোন শিক্ষার্থী গণিত অলিম্পিয়াডে জাতীয় পর্যায়ে অংশগ্রহনের সুযোগ পায়নি। ২০২২ সালে হায়ার সেকেন্ডারী  স্কুল সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষায় সে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। ২০২২-২০২৩ শিক্ষাবর্ষে  এমবিবিএস ভর্তি সৌরভ কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে দিনাজপুর সরকারি এম. আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজে (দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল) ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। সৌরভের এই সুবাস ছড়ানোর পিছনে রয়েছে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ভাব বাংলাদেশের সহযোগিতা ও দিকনির্দেশনার পাশাপাশি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শেখ মতিউর রহমানসহ স্কুল ও কলেজের শিক্ষকদের সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণা।

 

সৌরভ ভাব বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ২০১৮ সাল থেকে  গণিত অলিম্পিয়াড, বিতর্ক ও ইংরেজি বিষয়ের উপর একাধিক প্রশিক্ষণ এবং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছে। সৌরভ কৃতজ্ঞতা স্বীকার বলেন, ‘আমি ভাব বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞ কারণ ভাব বাংলাদেশ থেকে বৃত্তি ও বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ না পেলে আমি এতদূর আসতে পারতাম না। আমার স্বপ্ন পৃরণ করতে পারতাম না। আশা করি ম্যাডাম লায়লা চৌধুরীসহ ভাব বাংলাদেশ আমার পাশে থাকবে।‘  সৌরভের জন্য  অনেক অনেক শুভকামনা। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সৌরভের মত শত শত সুবিধাবঞ্চিত মেধাবী শিক্ষার্থী রয়েছে। মেধা থাকা সত্বেও একটু সহযোগিতা ও সঠিক দিকনির্দশনার অভাবে তাঁদের অনেকেই স্বপ্ন পূরণ করতে পারেনা। এসব সুবিধাবঞ্চিত মেধাবী শিক্ষার্থীদের যদি একটু যত্ন নেওয়া যায়; সঠিক পথে পরিচালিত করা যায়, তাহলে তাঁরা একদনি দেশের সম্পদে পরিণত হবে এবং আমরা যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখি তা বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।

লেখক: এম এ আলিম খান- সহকারি কান্ট্রি ডিরেক্টর,

ভলান্টিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ফর বাংলাদেশ (ভাব-বাংলাদেশ)

add 1


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো খবর

পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০  

আজকের দিন-তারিখ

  • রবিবার (সকাল ৬:০৮)
  • ২রা এপ্রিল, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ
  • ১১ই রমজান, ১৪৪৪ হিজরি
  • ১৯শে চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ (বসন্তকাল)